দেশে সুপরিচিত একটি ব্র্যান্ডের সুগন্ধি সাবানের সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য (এমআরপি) ঠিক এক বছর আগে ছিল ৫৮ টাকা (১৫০ গ্রাম)। একই সাবানের এখনকার দর ৭৫ টাকা। এক বছরে সাবানটির দাম বেড়েছে ২৯ শতাংশ।
শুধু সুগন্ধি সাবান নয়; দাম বেড়েছে কাপড় কাচার সাবান, গুঁড়া সাবান বা ডিটারজেন্ট, টুথপেস্ট, শ্যাম্পু, টিস্যুসহ নিত্যব্যবহার্য বিভিন্ন পণ্যের। এ মূল্যবৃদ্ধি সংসারের ব্যয় অনেকটাই বাড়িয়ে দিয়েছে।
মানুষকে বাজারে গিয়ে যেমন চাল, ডাল, তেল, চিনি, দুধ কিনতে ব্যাপক বাড়তি ব্যয় করতে হচ্ছে, তেমনি সাবান ও সমজাতীয় পণ্য কিনতে হচ্ছে আগের চেয়ে অনেক বেশি দামে।
রাজধানীর পাঁচটি কাঁচাবাজারের মুদিদোকানি এবং সাবানজাতীয় পণ্য বিপণনকারী কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে মূল্যবৃদ্ধির এ চিত্র পাওয়া গেছে। তারা বলছে, গত ছয় মাসে কয়েক দফায় দাম বেড়েছে। মূল্যবৃদ্ধির কারণ বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম, জাহাজভাড়া, মার্কিন ডলারের বিনিময় মূল্য ও দেশে পরিবহন খরচ বৃদ্ধি।
মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে জানতে চাইলে নিত্যব্যবহার্য পণ্য বা ফাস্ট মুভিং কনজ্যুমার গুডস (এফএমসিজি) খাতের শীর্ষস্থানীয় কোম্পানি ইউনিলিভার বাংলাদেশ লিমিটেডের পক্ষ থেকে প্রথম আলোকে জানানো হয়েছে, পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্ববাজারে গৃহে ব্যবহার্য (হোমকেয়ার) পণ্যের কাঁচামালের দাম বেড়েছে গড়ে ৬৮ শতাংশ। ত্বক সুরক্ষার পণ্যের কাঁচামালের দাম বেড়েছে ৬৯ শতাংশ। আর মুখ ও চুলের যত্নে ব্যবহৃত পণ্যের কাঁচামালের দাম বেড়েছে যথাক্রমে ৪০ ও ৫০ শতাংশ। এ জন্য প্রতিষ্ঠানটি তাদের পণ্যের দাম সমন্বয় করেছে।
ভোক্তা অধিকার সংগঠন কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) নিত্যপণ্যের দামের তথ্য সংরক্ষণ করে। সংগঠনটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দেশে উৎপাদিত বহুজাতিক কোম্পানির মাঝারি আকারের একটি সুগন্ধি সাবানের গড় দাম ২০১৯ সালে ছিল ৪৩ থেকে ৪৬ টাকা।
এখন একই সাবান বিক্রি হয় ৫৫ টাকা দরে। দেশীয় কোম্পানির দুটি ব্র্যান্ডের মাঝারি আকারের সুগন্ধি সাবানের দাম ছিল ৩০ টাকার আশপাশে। এখন একই সাবান বিক্রি হয় ৪৫ থেকে ৫০ টাকায়।
খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, দেশে সুগন্ধি সাবানের বাজারের আকার বার্ষিক প্রায় তিন হাজার কোটি টাকার। এ বাজারের অর্ধেকের বেশি ইউনিলিভারের হাতে। সাবানের বাজারে দ্বিতীয় অবস্থানে আছে স্কয়ার টয়লেট্রিজ। সুগন্ধি সাবানের বাজারের প্রায় ১০ শতাংশ মেরিলের হাতে।
গুঁড়া সাবানের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম ছিল ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া। সুগন্ধি সাবান, গুঁড়া সাবানসহ টয়লেট্রিজ পণ্যের বাজারটি খুবই প্রতিযোগিতামূলক। এখানে মুনাফার হারও কম। তাই উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম সমন্বয় করা ছাড়া কোম্পানিগুলোর হাতে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।
মোহাম্মদ সাঈদ, স্কয়ার টয়লেট্রিজের পরিচালক মালিক
সাবানের বাজারের বিদ্যমান একাধিক কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গত জানুয়ারি মাসে ১০০ গ্রাম ওজনের একটি সুগন্ধি ব্র্যান্ডের সাবানের দাম ছিল ৪০ টাকা। এরপর কয়েক দফায় এ দাম বেড়ে এখন দাঁড়িয়েছে ৫৫ টাকায়। সেই হিসাবে আট মাসের ব্যবধানে ১০০ গ্রাম ওজনের একটি সুগন্ধি সাবানের দাম বেড়েছে প্রায় সাড়ে ৩৭ শতাংশ। তবে ওজনভেদে বাজারে সুগন্ধি সাবানের দাম ভিন্ন ভিন্ন।
জানতে চাইলে ইউনিলিভার বাংলাদেশের করপোরেট অ্যাফেয়ার্স ও পার্টনারশিপস অ্যান্ড কমিউনিকেশনস বিভাগের পরিচালক শামীমা আক্তার বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে বিশ্ববাজারে কাঁচামালের দাম উল্লেখযোগ্য হারে বেড়ে গেছে। সেই সঙ্গে বেড়েছে জাহাজভাড়া, পরিবহন খরচ ও ডলারের দাম। এসব কারণে উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় বাধ্য হয়ে দাম সমন্বয় করতে হয়েছে।
বেড়েছে গুঁড়া সাবানের দামও। বাজারে বিভিন্ন ব্র্যান্ডের গুঁড়া সাবান আছে। এর মধ্যে সুপরিচিত একটি ব্র্যান্ডের গুঁড়া সাবানের মূল্যবৃদ্ধির চিত্রটি দেখা যাক। গত এপ্রিলের মাঝামাঝিতে ওই ব্র্যান্ডের এক কেজি গুঁড়া সাবানের দাম ছিল ১৪০ টাকা। মোড়ক যাচাই করে দেখা যায়, আগস্টের তৃতীয় সপ্তাহে উৎপাদিত একই ব্র্যান্ডের সমপরিমাণ গুঁড়া সাবানের খুচরা মূল্য রাখা হচ্ছে ১৮০ টাকা।
গুঁড়া সাবানের সুপরিচিত আরেকটি ব্র্যান্ডের এক কেজির প্যাকেটের নতুন দর নির্ধারণ করা হয়েছে ১৪০ টাকা, যা গত জুনেও ১১৫ টাকা ছিল। দেশীয় তিনটি কোম্পানির তিন ব্র্যান্ডের গুঁড়া সাবানের দাম কেজিপ্রতি ১১০ টাকার আশপাশে। দোকানিরা বলছেন, এসব ব্র্যান্ডের গুঁড়া সাবানেরও দাম বেড়েছে। তবে মূল্যবৃদ্ধির হার জনপ্রিয় ব্র্যান্ডের তুলনায় কম।
এসব পণ্যের দাম অনেকটা অগোচরে সংসারের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ জন্য তিনি এ খানেও ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পরিবারে মাসে দুই কেজির মতো কাপড় কাচার পাউডার সাবান লাগত। বাসায় বলেছি সাশ্রয়ী হতে, যাতে পাউডার কম লাগে।’
রফিকুল ইসলাম, রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা
মুদিদোকানিরা বলছেন, কাপড় কাচার সাবানের দামও দফায় দফায় বেড়েছে। সুপরিচিত একটি ব্র্যান্ডের কাপড় কাচা সাবানের (১২৫ গ্রাম) দাম এক বছর আগে ছিল ২০ টাকা, এখন তা ২৫ টাকা। মূল্যবৃদ্ধির হার ২৫ শতাংশ। বিক্রেতাদের দাবি, কয়েকটি কোম্পানির ১২৫ থেকে ১৩০ গ্রাম ওজনের কাপড় কাচা সাবানের খুচরা দর এক বছরের ব্যবধানে ১৫ টাকা থেকে বেড়ে হয়েছে ২৪ টাকা। বেড়েছে থালাবাসন ধোয়ার সাবানের দামও।
ওয়াশিং পাউডার বা গুঁড়া সাবানের ব্যবসার সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোম্পানির সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, গুঁড়া সাবানের বাজারটি প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকার। এ বাজারে আছে ইউনিলিভার, স্কয়ার, কোহিনূরসহ বিভিন্ন কোম্পানির বিভিন্ন ব্র্যান্ডের পণ্য। খাতসংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা জানান, এ বছরের শুরুতে অর্থাৎ জানুয়ারি মাসে ৫০০ গ্রাম ওজনের এক প্যাকেট গুঁড়া সাবানের দাম ছিল ৬০ টাকা। দফায় দফায় দাম বেড়ে বাজারে এখন তা বিক্রি হচ্ছে ৯০ টাকায়। সেই হিসাবে আট মাসের ব্যবধানে ৫০০ গ্রাম ওজনের এক প্যাকেট গুঁড়া সাবানের দাম বেড়ে দেড় গুণ হয়ে গেছে।
জানতে চাইলে স্কয়ার টয়লেট্রিজের পরিচালক মালিক মোহাম্মদ সাঈদ প্রথম আলোকে বলেন, গুঁড়া সাবানের মূল্যবৃদ্ধির পেছনে অনেক কারণের মধ্যে অন্যতম ছিল ডলারের দাম বেড়ে যাওয়া। সুগন্ধি সাবান, গুঁড়া সাবানসহ টয়লেট্রিজ পণ্যের বাজারটি খুবই প্রতিযোগিতামূলক। এখানে মুনাফার হারও কম। তাই উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় দাম সমন্বয় করা ছাড়া কোম্পানিগুলোর হাতে অন্য কোনো বিকল্প ছিল না।
মুদিদোকানিরা বলছেন, টুথপেস্টের দামও বেড়েছে। তবে সাবানের মতো অত বেশি হারে নয়। ১০০ গ্রামের একেকটি টিউবের টুথপেস্টের দাম বেড়েছে ১০ থেকে ২০ টাকা। গত এপ্রিল, মে মাসেও ১০০ গ্রাম ওজনের একেকটি টিউবের টুথপেস্টের দাম ছিল ৭০ থেকে ৭৫ টাকা। এখন তা বেড়ে হয়েছে ৮৫ থেকে ৯৫ টাকা। সেই হিসাবে কয়েক মাসের ব্যবধানে টুথপেস্টের দাম বেড়েছে ২১ থেকে ২৭ শতাংশ পর্যন্ত। আর শ্যাম্পুর মাঝারি আকারের বোতলের দাম বেড়েছে ২০ টাকার মতো।
যেমন জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ডের ১৮০ মিলিলিটারের এক বোতল শ্যাম্পুর দাম এখন ২৭০ টাকা, যা এ বছরের শুরুতে ছিল ২৫০ টাকা।
টিস্যু বিপণনকারী কোম্পানিগুলো কোনো কোনো ক্ষেত্রে দাম ঠিক রেখে পরিমাণ কমিয়েছে। আবার কোনো ক্ষেত্রে পরিমাণ ঠিক রেখে দাম বাড়িয়েছে। যেমন জনপ্রিয় একটি ব্র্যান্ডের টয়লেট টিস্যুর বর্তমান খুচরা দর ৩০ টাকা, যা এক মাস আগে ছিল ২৫ টাকা এবং এক বছর আগে ছিল ২০ টাকা।
রাজধানীর তেজগাঁও এলাকার বাসিন্দা রফিকুল ইসলাম প্রথম আলোকে বলেন, এসব পণ্যের দাম অনেকটা অগোচরে সংসারের খরচ বাড়িয়ে দিচ্ছে। এ জন্য তিনি এ খানেও ব্যয় কমাতে বাধ্য হয়েছেন। তিনি বলেন, ‘পরিবারে মাসে দুই কেজির মতো কাপড় কাচার পাউডার সাবান লাগত। বাসায় বলেছি সাশ্রয়ী হতে, যাতে পাউডার কম লাগে।’