১৮ দিন কর্মবিরতি হলো। তার বিনিময়ে পাওয়া গেল ১২০ থেকে ১৭০ টাকা মজুরি। হিসাব ধরা হলো, বাসাভাড়া-সবজি উৎপাদনের একফালি জমি আর রেশন। দুই শ বছর ধরে একই জায়গায় বসবাস করেও বাড়ি–ভিটার মালিক চা-শ্রমিকেরা নন। সিলেট-মৌলভীবাজারের টি স্টেটগুলো তবে বাংলাদেশের বাইরে। এখনো আইন রয়েছে, ৬০ বছর ধরে সরকারি জমিতে বাস করলে সেই জমির মালিক হবেন বসবাসকারী। তবে?
১৯১৫ সালে বাংলা পুলিশের ডেপুটি ইন্সপেক্টর জেনারেল এফ সি ডালি একটি বই লেখেন। বইটির নাম ‘বাঙ্গালাদেশে যে সকল দুর্ব্বৃত্ত জাতি চুরি ডাকাইতি প্রভৃতি করে তাহাদের সম্বন্ধে পুস্তক’। সেখানে তিনি লিখেছেন, বাংলার অধিবাসী এবং অন্য প্রদেশ থেকে আসা লোকদের মধ্যে যারা চুরি-ডাকাতি করে, তাদের কার্যপ্রণালি সম্পর্কে পুলিশের কর্মচারীদের শিক্ষা দেওয়াই এই বই লেখার উদ্দেশ্য। উল্লেখ্য, চা–শ্রমিকদেরও সেই দুর্বৃত্ত জাতির অন্তর্ভুক্ত করেছিল ব্রিটিশরাজ। জমির মালিক না হওয়ায় কয়েকজন তরুণ অতীতে পুলিশের চাকরি করতে পারেননি। পুলিশে নিয়োগ পাওয়া আসপিয়ার ঘটনা যখন সামনে এল, তখন বিষয়টা আমরা জানতে পারি।
ফটিকছড়ি-পঞ্চগড়ের চা–শ্রমিকদের তুলনায় অর্ধেকের চেয়েও কম সিলেটে। দেশের চা–বাগানগুলোতেই মজুরির এই বৈষম্য কেন হবে? এ তো নয়, একেক বাগানের মালিকের ব্যবসার ক্ষেত্র আলাদা। একই মার্কেটেই তো তাঁদের ব্যবসা, মুনাফাও একইভাবে করেন। তাহলে?
কুলিকা বাচ্চা/কভি নাহি আচ্ছা। পুরুষ শ্রমিকদের বলা হতো মর্দনা আর নারীদের রেন্ডি বলা হতো। এর চেয়ে ভালো শব্দ তাদের জন্য বরাদ্দ নয়। এখানকার আদি বাগানমালিকেরা ওয়েস্ট ইন্ডিজে দাস মালিক ছিলেন। চা–শ্রমিকেরা তাঁদের কাছে ভূমিদাসই ছিলেন। ১৮৬০ সালের নীল কমিশনের প্রতিবেদনেও তাঁদের অত্যাচারের প্রমাণ আছে। পাকিস্তান হলো, জমিদারি গেল; সবাই জমি পেলেন, রায়তরা কৃষক হলেন, বাগানের শ্রমিকেরা ভূমিদাসই রয়ে গেলেন। যে জমিতে দুই শ বছর ধরে বাস, না হলে সেই জমির ভাড়া এখনো বাগানের মালিকেরা মজুরি থেকে কেটে নিচ্ছেন কীভাবে?
সারা দেশে কয়েক লাখ ভূমিহীনকে জমিসহ ঘর তুলে দেওয়া হলো। সামাজিক নিরাপত্তার যে অধিকার দেশের অন্য নাগরিকেরা ভোগ করেন, চা–বাগানের শ্রমিকেরা তার বাইরে রইলেন কেন? নাকি তাঁরা বে–নাগরিক? দুইবার দেশবদল হলো, বদল হলেন বাগানমালিকও। মুক্তিযুদ্ধের প্রথম প্রহরে প্রতিরোধও গড়ে তুললেন চা–বাগানের শ্রমিকেরা। জমিদারি গেল, সবাই জমি পেল; তবু রয়ে গেল টি স্টেট, আর ভূমিদাস চা-শ্রমিকেরা।
- নাহিদ হাসান লেখক ও সংগঠক।
nahidknowledge@gmail.com