অ্যালার্ম শুনে ধড়মড় করে উঠে বসি। জানালার বাইরে তখনো নিঃসীম আঁধার কিন্তু আমাদের হাতে একদম সময় নেই। ঝটপট রেডি হয়ে সস্ত্রীক বেরিয়ে পড়ি হোটেল থেকে।
ভারতের আগরতলায় এসেছি দুদিন আগে। উজ্জয়ন্ত প্রাসাদ, নীরমহল, রুদ্রসাগর, সবই ঘুরে দেখা হয়েছে। কিন্তু যার টানে এই ত্রিপুরা-ভ্রমণে ছুটে আসা, সে এখনো আছে চোখের আড়ালে। আজই হবে চক্ষুকর্ণের বিবাদভঞ্জন।
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বৃহৎ উপন্যাস প্রথম আলো পড়েছি সেই কিশোর বয়সে। একটা অংশ এখনো মনে পড়ে:
‘পাশেই দেয়ালের মতন যে খাড়া পাহাড়, সেদিকে তাকিয়ে দুজনেই বিস্ময়ের শব্দ করে উঠলেন। সেই পাথুরে দেয়ালের গায়ে খোদাই করা আছে একটি বিশাল মুখ। তার তিনটি চোখ, একদিকে একটি ত্রিশূল।
মহারাজ অস্ফুট স্বরে বললেন, কালভৈরব!
শশীভূষণ ঘোড়া থেকে নেমে চামড়ার ব্যাগ খুলে ক্যামেরা বার করলেন। এদিক-ওদিক তাকাতে তাকাতে বললেন, আরও অনেক খোদাই করা মূর্তি আছে। ওই যে বিষ্ণু, সুদর্শন চক্র, গরুড়…
ঝরনাটির জলধারা ক্ষীণ, হেঁটে পার হয়ে এলেন দুজনে। পাহাড়ের গায়ে দেখতে লাগলেন একের পর এক মূর্তি।
বীরচন্দ্র বললেন, এই সেই ঊনকোটি তীর্থ!’
অটো নিয়ে ফাঁকা শহরের রাস্তাঘাট পার হয়ে যখন আগরতলা রেলস্টেশনে এসে পৌঁছালাম, তখন সবে দিনের আলো ফুটছে। রেলস্টেশনের লম্বা সাদা দালানটাও এক দর্শনীয় স্থাপত্য। কিন্তু বাইরে বেশি সময় নষ্ট না করে, আমরা স্টেশনের ভেতরে চলে যাই। আমাদের লক্ষ্য সকাল ৬টা ১৫ মিনিটের আগরতলা-ধর্মনগর প্যাসেঞ্জার ট্রেন। লাইনে দাঁড়িয়ে টিকিট কেটে সকাল ছয়টার আগেই নীল ট্রেনটার ভেতরের নীল সিটে বসে পড়ি।
কিছুক্ষণের মধ্যেই মানুষে মানুষে ভরে যায় রেলগাড়ি। এঁকেবেঁকে শুয়ে থাকা প্রকাণ্ড অজগর সাপটা একটু পরেই হাতির মতো তীক্ষ্ণ ডাক ছেড়ে ড্রাগনের মতো আগুনের ধোঁয়া ছেড়ে শামুকের মতো নড়েচড়ে ওঠে। কাঁটায় কাঁটায় এক্কেবারে ঠিক সময়ে ছেড়ে দিল ট্রেন। আমাদের গন্তব্য ঊনকোটি।
ধীরে ধীরে বাইরের প্রকৃতি পাল্টে যেতে থাকে। সমভূমি আর জলাভূমি পার হয়ে পাহাড়ি এলাকায় ঢুকে পড়ি আমরা। গিরি আর গিরিখাতকে দুপাশে নিয়ে ঝমাঝম ছুটে চলেছে গাড়ি। হঠাৎ করেই পাহাড় কেটে বানানো টানেলে ঢুকে পড়ে ট্রেন। ভেতরে শুধুই ঘুটঘুটে অন্ধকার, কু ঝিকঝিক, আর গুম গুম প্রতিধ্বনি। চলার পথে এ রকম তিনটা টানেল পার হই আমরা।
ধর্মনগর পর্যন্ত যাব না আমরা। প্রায় তিন ঘণ্টায় ১০৮ কিলোমিটার পথ পার হয়ে নেমে যাই কুমারঘাট স্টেশনে। একটা ট্যাক্সি রিজার্ভ করে রওনা দিই এবার। পথের পাশের ছোট্ট রেস্তোরাঁয় রুটি, সবজি আর দই দিয়ে ভারতীয় ধাঁচের নিরামিষ জলযোগ সেরে আবারও পথে। উঁচু–নিচু পথের অসংখ্য বাঁক পার হয়ে ২৭ কিলোমিটার পাড়ি দিয়ে অবশেষে পৌঁছে যাই ঊনকোটি।
আখাউড়া আর আগরতলা হয়ে না এসে আমরা চাইলে মৌলভীবাজারের শমশেরনগর হয়ে চাতলাপুর স্থলবন্দর পার হয়ে ত্রিপুরার কৈলাশহরে পৌঁছাতে পারতাম। সেখান থেকে মাত্র আট কিলোমিটার দূরেই ঊনকোটি। তার মানে আমাদের দেশ থেকে বলতে গেলে একেবারে হাঁটাপথের দূরত্বে এই রহস্যময় পুরা তীর্থ।
অনেক বছর আগে কলকাতার ভ্রমণ পত্রিকায় এক পৃষ্ঠা জোড়া একটা ছবি দেখে চমকে গিয়েছিলাম। খাড়া পাহাড়ের গায়ে খোদাই করা তিন চোখ মেলে তাকানো ৩০ ফুট উঁচু এক মুখ। সে কালভৈরব আমার স্মৃতিতে এখনো ঝকঝকে পরিষ্কার। জায়গাটা আমাদের ঘরের পাশের ত্রিপুরায় জেনে উদ্বেলিত হয়েছিলাম, চলেই যাব যখন-তখন। অবশেষে এসে দাঁড়িয়েছি সে ঊনকোটির গেটের বাইরে।
টিকিট কেটে গেটের ভেতরে ঢুকে সোজা পথটা ধরে কিছু দূর যেতেই হাতের ডানে পাহাড়ের খাড়া দেয়াল। দেয়ালের ন্যাড়া পাথরে খোদাই করা বিশাল সব মুখ। একটু পরেই পথ নেমে গেছে নিচের দিকে। খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নামার আগে একটুখানি থমকে দাঁড়াই। আমার পথ চলে গেছে অতল গভীরে আর ঠিক উল্টো দিকে পাহাড়ের আরেক খাড়া দেয়াল। সে দেয়ালের সবুজ ঘাসের আবরণের মাঝে মাঝেই বের হয়ে আছে কালচে পাথুরে গা আর সেসব পাথরের গায়ে ফুটে আছে অগুনতি দেবমূর্তি।
দেবমূর্তিগুলো নিয়ে একটা কাহিনি চালু আছে। সে অনেক কাল আগেকার কথা। হিন্দু দেবতা শিব সপারিষদ কাশী যাচ্ছিলেন। সঙ্গীসাথিসহ মোট এক কোটি দেব-দেবী। পথে এই রঘুনন্দন পাহাড়ে সবাই যাত্রাবিরতি করলেন। রাতে ঘুমাতে যাওয়ার আগে শিব সবাইকে ডেকে ডেকে বললেন, যাতে তাকে সূর্যোদয়ের আগেই উঠিয়ে দেওয়া হয়, সবাই তখন আবার কাশীর দিকে রওনা দেবেন। কিন্তু বেশ বেলা করে ঘুম থেকে উঠে শিব দেখেন বাকি সবাই তখনো গভীর ঘুমে অচেতন। প্রচণ্ড রাগে শিব অভিশাপ দিলেন, আর সঙ্গীসাথি সবাই পাথরের মূর্তিতে পরিণত হলেন। শিব ছাড়া বাকি সবাই প্রস্তরীভূত হওয়ায় মূর্তির মোট সংখ্যা হলো এক কোটি থেকে এক কম। জায়গাটার নাম হলো তাই ‘ঊনকোটি’।
পাহাড়ের গায়ে ঘুরিয়ে–পেঁচিয়ে বসানো অসংখ্য সিঁড়ি বেয়ে অনেক অনেক খোদিত মুখ দেখতে দেখতে পৌঁছালাম ছোট কুলকুলে ঝরনাটার সামনে। ঠিক পাশেই বিশাল সে কালভৈরব। আমি মুগ্ধ বিস্ময়ে স্পর্শ করি নাক, চোখ, গাল, ঠোঁট। বাস্তবিক ছুঁয়ে দিই ইতিহাস, কিংবদন্তি, স্থাপত্য, শিল্পজ্ঞান আর সময়কে।
উল্টো দিকের পাহাড়ের গায়ের সিঁড়ি বেয়ে উঠতে থাকি এবার। এই সিঁড়িগুলো অনেক বেশি খাড়া। রেলিং ধরে খুব সাবধানে উঠতে হচ্ছে। সিঁড়ি বেয়ে ওঠার সময়েই দুই পাশে পাহাড়ের গায়ে মূর্তিগুলো দেখা যায়। বিষ্ণু, হিড়িম্বা, গরুড়, হনুমান, নন্দী। আর পাহাড়ের একেবারে নিচের দিকে আছে গণেশ, যার শারীরিক গঠন অনেকটা ক্ষীণ, পুরাণের বর্ণনার সঙ্গে যা মেলে না।
এই অযুত মূর্তি স্থাপনের সঠিক ইতিহাস এখনো অজানা। ধারণা করা হয় অষ্টম বা নবম শতকে এসব স্থাপত্য প্রতিষ্ঠিত হয়। পরবর্তী সময়ে খননকাজ আর সংস্কারের সময়ে এখানে বিষ্ণু, হর-গৌরী, নরসিংহ, গণেশ, হনুমান, এ রকম কিছু ভাস্কর্য পাওয়া যায়। পাহাড়ের চূড়ায় পৌঁছে দেখি, পুরোনো এক মন্দিরের ভগ্নস্তূপ, যা দেখে ধারণা করা হয় যে এখানে কোনো মন্দির ছিল। এই পাহাড়ের চূড়াতেই আলাদা এক বদ্ধ ঘরে সংরক্ষিত আছে উদ্ধার করা ভাস্কর্যগুলো।
নামার সময় পাতালে নেমে যাওয়া সিঁড়ির সারি দেখেই মাথা চক্কর দিয়ে ওঠে। একটু অসাবধান হলেই পা পিছলে আলুর দম হওয়ার জোর আশঙ্কা। তাই লোহার রেলিং শক্ত হাতে ধরে খুব ধীরে ধীরে নামতে থাকি। কালভৈরব আর ব্রহ্মকু-ঝরনা পার হয়ে আবার সিঁড়ি বেয়ে ওঠা। দুই ঘণ্টায় চার-পাঁচ শ সিঁড়ি ওঠানামা করে এবার আবার গেটের দিকে এগিয়ে যাওয়া।
প্রায় দেড় হাজার বছর ধরে সহস্রাধিক দৈবদুর্বিপাক সয়ে অনড় পাহাড়ের গায়ে স্থির অবিচল আছে অগণন মূর্তি। এই মুহূর্তে এই বসুধার বুকে যে সহস্র-কোটি মনুষ্য সন্তান গর্বভরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছে, শত বছর পেরোনোর আগেই তারা সবাই হারিয়ে যাবে। কিন্তু সহস্র কিংবা হয়তো কোটি বছর ধরেই টিকে থাকবে এ ঊনকোটি।